#শোনাগল্প ০৫
সুর, বেসুর ও অসুর
যারা ধ্রুপদী-সঙ্গীত চর্চা করেন তারা সঙ্গীতকে অন্যমাত্রায় শ্রদ্ধা করেন, সাধারণ মানুষের মতো যখন তখন 'আইয়্যে না বালামা ক্যায়া কারু সাজনী' গেয়ে উঠতে পারেন না। তারা পরিবেশ ছাড়া কন্ঠসুধা প্রয়োগ করেন না।
কিন্তু সবাই তো আর ধ্রুপদী সঙ্গীত নিয়ে বিভোর নয়। তাই বাথরুম সিঙ্গার থেকে শুরু করে স্ট্রিট সিঙ্গার এবং নতুন নতুন আইডল সিঙ্গারের অভাব নেই।
যাকে নিয়ে এই গল্প তিনি এই শহরের একজন সুধী লেখকও বটে, উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি লেখালেখি করেন। তিনি আবার আহমদ ছফার ঝিগরি দোস্ত!
একদিন এই দুই মহারথী কোনো এক প্রকাশনার কাজে রিকশায় করে পুরোনো ঢাকার অলিগলি ভেঙে যাচ্ছেন বাংলাবাজার। তখনকার দিনে রাস্তায় এত জ্যাম ছিলো না তাই রিকশা তরতর করে এগুচ্ছে... পুরোনো ঢাকায় বুড়িগঙ্গার হাওয়া মন কিছুটা নরম করে দেয় সবারই। আহমদ ছফা গান ধরেন। উদাত্ত গলায় বেশ জোরেসোরে... রিকশায় বসে গাইলেও, আলুবাজারের জমিলার মা চারতলায় মেঝে মুছতে মুছতে শোনে, কে যেন রিকশা চড়ে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে! ম্যায় তো চলি পিয়া কে দেশ... নাইওরি টুটরি যায়ে.. নাইওরি টুটরি যায়ে...
কি শুরু করলেন ছফা ভাই! আঁতকে ওঠেন শিল্পী।
গান গাইতাছি। নির্লিপ্ত গলায় বলেন ছফা।
"এইটা কোনো গাওয়া হইল? গানটারে অপমান করতাছেন আপনে! আর কি গলা! থামেন মিয়া!" শিল্পী সরোষে রোষ প্রকাশ করেন।
ছফা বাঁশি বাজান। ছোটোবেলায় গান শিখেছেন। তিনি এ কথা মানবেন কেনো?
তাইলে আপনে গান... আমি আমার মতো গাইমু... আমার মনের আনন্দে... আপনে কাইন্দা কাইন্দা গান। তিনি আবার শুরু করেন, বাবুলা মোরা... নাইওরি টুটরি যায়ে... নাই-ও-রি টুট-রি যা----য়ে...
ধুর্ মিয়া থামেন! ধমকে ওঠেন শিল্পী।
এত বেসুরা যে কানে লাগে... আপনে ওইসবের অলঙ্করণ বুঝবেন না। থামেন।
এবার অপমানিত বোধ করেন ছফা।
কি কইলেন? আমি সুর বুঝি না! আপনে আমার **টা বুঝেন! ইমোশনের সাথে যোগ নাই আপনাগ সুরে, আত্মার সাথে যোগ তো দূর কি বাত। আছেন খালি অলঙ্করণ লয়্যা! তিনি আবার শুরু করেন... ই কাঙনা ভি টুটে আভি... নাই-ও-রি টুট-রি যা----য়ে... তিনি মহাআনন্দে আছেন... নাইওরি টুটে যাবার বেদনা তিনি আনন্দে চিতকার করে জানাচ্ছেন!
এবার মিনমিনে গলায় আবেদন করেন শিল্পী... ছফা ভাই প্লিজ থামেন। আমি আপনার সাথে বসতেই পারতাছি না।
ছফা গলা চড়িয়ে দেন... চার কাহার মিলকে মেরি ঢোলিয়াআআআআআআ্, মেরি ঢোলিয়া সাজাআআআয়ে.....
শিল্পী রিকশা থামান ইংলিশ রোডের মোড়ে। বাংলাবাজার পর্যন্ত ভাড়া মিটিয়ে করুণ মুখে বলেন...
ছফা ভাই, আপনে রিকশায় একাই যান। বাকী রাস্তাটুকু আমি হাঁইটা যামু।
আহমদ ছফা রাশভারী গলায় বলেন, এর কারণ কি জানতে পারি?
তিনি হন্ হন্ করে হাঁটতে থাকেন বাংলাবাজারের দিকে। যেতে যেতে বলেন,
সুরের সাথে থাকি ভাই। বেসুরোকেও সহ্য করি কিন্তু.... অসুরকে আমি সহ্য করতে পারি না্।
Comments
Post a Comment